মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক শফি উদ্দিন তালুকদার (৫৪) আর নেই। তিনি বুধবার ভোরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
শফিউদ্দিন তালুকদার ১৯৬৭ সালে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের যমুনার চর এলাকা জুঙ্গীপুর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কুদরত আলী তালুকদার ও মাতা সখিনা বেগম। তিনি ভূঞাপুর শহরের ফসলান্দিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন।
অসাম্প্রয়িক চেতনার একজন নিবেদিত প্রাণ শফি উদ্দিন তালুকদার। তৃণমূল পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঘটনার তথ্য নিরলসভাবে সংগ্রহ করে জাতির কাছে তুলে ধরেছেন। স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বার্তা তুলে দিতে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই গৌরবময় কাজটি আমৃত্যু করেছেন বীরের বেশে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ ও গবেষণা যেন তাঁর হৃদয়ের সাথে জড়িত।
শফি উদ্দিন তালুকদার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভূঞাপুরের নিকরাইলের শমসের ফকির ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। কলেজ শিক্ষিকা স্ত্রী কল্পনা কলপনা পারভীন ও একমাত্র পুত্র র্যাইয়ান উৎসব তালুকদারকে নিয়ে তাঁর ছিল সুখের সংসার। আকষ্মিক মৃত্যু স্বজন, শুভাকাঙ্খী ও কর্মজগতের কেউই মেনে নিতে পারছেন না।
তাঁর গবেষণাধর্মী উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘মুক্তিযুদ্ধে ভূঞাপুর’, ‘বাংলাদেশের আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা’, ‘একাত্তরের গণহত্যা : যমুনার পূর্ব পশ্চিম’, ‘একাত্তরের বয়ান’। এছাড়া প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে- ‘মুক্তিযুদ্ধে হাজং আদিবাসী’, ‘আদিবাসী গারো মুক্তিযোদ্ধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতিচারণ: আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা’ ‘মুক্তিযুদ্ধে ভূঞাপুরের ঐতিহাসিক ঘটনা’, ‘সাটিয়াচড়া-গোড়ান গণহত্যা’, ‘আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যারাণী সাংমা’, ‘সিরাজকান্দি জাহাজমারা যুদ্ধ’, ‘ছাব্বিশা গণহত্যা দিবস, ‘ভূঞাপুর ডাকবাংলো মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর হোক’ ইত্যাদি। তাঁর লেখা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো।
মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও তিনি ফোকলোর ও আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। এ সম্পর্কিত কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদ, বাংলা একাডেমি ও ইতিহাস একাডেমির সদস্য।
সাদা মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত শফিউদ্দিন তালুকদারের নামাযে জানাযা বুধবার বিকেলে প্রথমে নিকরাইল শমসের ফকির ডিগ্রি কলেজ মাঠে ও পরে ভূঞাপুর মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁকে ভূঞাপুরের ছব্বিশাস্থ কেন্দ্রীয় গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
জানাযায় টাঙ্গাইল-২(গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির, ভূঞাপুর উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম বাবু, পৌরসভার মেয়র বীরমুক্তিযোদ্ধা মাসুদুল হক মাসুদ, উপজেলা আওয়ালীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তাহেরুল ইসলাম তোতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তিনি অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
উপস্থিত ব্যক্তিরা শফি উদ্দিন তালুকদার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, জাতি অকালে হারালো একজন দেশপ্রেমিক সন্তানকে। তিনি জীবিত থাকলে আরো অনেক কিছু দিয়ে যেতে পারতেন। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মই তাঁকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে দীর্ঘকাল।
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি
আপনার মন্তব্য লিখুন...