ফুলু রানী দাস (লিপি) এর নিঃসঙ্গ জীবনের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তার চায়ের দোকান। স্বামীর ঘর করতে না পারা এবং একমাত্র কন্যা সন্তান বিয়ে দেয়ার পর সঙ্গী হিসেবেই মনে করেন তার এই লিপি টি স্টল।
৮/১০ বছর আগে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের প্রশাসক ফজলুর রহমান খান ফারুকের পুত্র জেলা যুবলীগের সহÑসভাপতি এবং চেম্বার অফ কমার্সের সাধারণ সম্পাদক খান আহমেদ শুভ এর আর্থিক সহযোগিতায় একটা ভাসমান দোকান ক্রয় করে সেখানেই জীবন চালানোর অবলম্বন খুঁজে পায় লিপি।
লিপির বয়স এখন ৩৭ বছর। লিপির সাথে প্রতিবেদকের আলাপকালে তার নিঃসঙ্গ জীবনের দুঃসহ দিনগুলোর কথা ভেসে উঠে তার চোখে-মুখে। ব্যথাতুর কণ্ঠে ফেলে আসা স্মৃতি বলতে বলতে কান্নায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন তিনি।
টাঙ্গাইল শহরের প্রাণকেন্দ্র থানা পাড়ার নারায়ন চন্দ্র দাসের মেয়ে এই লিপি। ৮ ভাই বোনের মধ্যে ৭ম তিনি। বাবা নিজ এলাকায় আটা ভাঙিয়ে কোন রকমে স্ত্রী সহ ৮ সন্তান নিয়ে সংসার চালাতেন। ১৯৮৮ সনে লিপির বয়স যখন ৮-১০ বৎসর তখন তার বাবা মারা যায়। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে মায়ের কাঁধে। অভাবের তাড়নায় মা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। তারই ফলশ্র“তিতে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন।
একুশ বছর আগে বিয়ে হয় সখিপুর উপজেলার বেরবাড়ী চাকদহ গ্রামের মনোরঞ্জন দাসের সাথে লিপির। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই তার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। সংসার জীবনের নয়নের মনি মনে করে তার নাম রাখেন দৃষ্টি রানী দাস। সুখেই কাটছিলো তাদের জীবন।
কিন্তু প্রবাদে আছে সবার কপালে সুখ সয় না। তাদের এই নয়ন মনির নয়ন জুড়ানো দৃষ্টির ভালবাসাও আটকাতে পারল না মা বাবার সংসার। দৃষ্টির বয়স তিন বছর হতে না হতেই সন্তান সহ স্বামীর ভিটা ছাড়তে হয় লিপিকে।
আশ্রয় নিতে হয় বাবার বাড়িতে। বাবার বাড়ির অবস্থাও সচ্ছল না। দারিদ্র্যতার সাথে যুদ্ধ করেই টিকে আছে তারা। তার উপর শিশু সন্তান নিয়ে তাদের আশ্রয়ে থাকতে হয় তাকে। প্রতিনিয়ত কথার ঘাঁ শুনতে হয় তাকে। নিজে বেকার তার উপর কন্যা সন্তানকে খাইয়ে-পড়িয়ে মানুষ করা লিপি ভাবে আর কাঁদে। হাল ছাড়ে না সে। কিছু একটা করতে হবে। নিজে বাঁচতে হবে আর নয়ন মনিকেও বাঁচাতে হবে। তাকে মানুষের মত মানুষ করতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন কাজের। কাজ ছাড়া চলতে পারব না, দৃষ্টিকেও মানুষ করতে পারব না। ভাইবোনদের বোঝা হয়ে থাকাও সম্ভব নয়।
এদিকে নিজে শিক্ষিত না যে চাকুরির চেষ্টা করবে। তার কাজ করার আগ্রহ আর প্রয়োজনের কথা শুনে তার এক প্রতিবেশী কাগজের ঠুঙ্গা বানানোর কাজ জোগার করে দেয়। শুরু হয় তার সন্তান সহ বেঁচে থাকার সংগ্রামি জীবন। সারাদিন ঠুঙ্গা বানিয়ে যে পারিশ্রমিক পায় তা দিয়ে কোনরকমে জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করেন তার আর একমাত্র সন্তান দৃষ্টির।
একদিকে সন্তানের মুখে আহার তুলে দেয়ার যুদ্ধ, অপরদিকে সন্তানকে মানুষ করার চিন্তা। কোথায় যাবে সে, কে দেবে তাকে বেঁচে থাকার সাহস, কে বাড়াবে সন্তান মানুষ করার জন্য সহযোগিতার হাত ? এমনি দুশ্চিন্তা যখন তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, সে সময় তার পাশে এসে দাঁড়ান খান আহমেদ শুভ এবং তার বাবা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খান ফারুক। ছেলে শুভ দিয়েছেন ভাসমান চায়ের দোকান করে, লিপির জীবন চালানোর নিজস্ব ঠিকানা করে। আর শুভ’র বাবা দিয়েছেন স্থায়ী দোকানের ব্যবস্থা করে ‘লিপি টি স্টল’ ।
টাঙ্গাইলের থানা পাড়া ছয়আনী পুকুর পাড়ে ‘লিপি টি স্টল’ বললে এখন সবাই চিনে। এমন সহযোগিতার কথা বলতে বলতে আবেগ আপ্লুত হয়ে কান্নায় কথা জড়িয়ে আসে লিপির।
এখন তার চাওয়া কি এমন প্রশ্নের জবাবে লিপি বলেন, আমার মেয়েটিও বিয়ে দিয়েছি। সকলের দোয়ায় সুখেই আছে। আমি চাই আমার সন্তানের অধিকার। তার অধিকার রক্ষার জন্য আজ থেকে ১৫ বছর আগে আমি আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেছি। কিন্তু মামলার কোন সুরাহা পাইনি। আমিতো আমার জীবন বাবার বাড়িতে কাটিয়ে দিলাম, আমার সন্তান যেন তার বাবার বাড়ির অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় এমনটাই চাওয়া সমাজ এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে।
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি
আপনার মন্তব্য লিখুন...