পাঁচ দশকের দিনমজুরীতেও ঘোচেনি সয়ান আলী শেখ (৭০)এর সংসারের অভাব অনটন। দাদা আর বাবার পথ অনুস্মরণ করে বেছে নেয়া দিনমজুরীতে এতদিন কোন ভাবে জীবন আর জীবিকা চালিয়ে আসলেও এখন বয়স আর অভাব অনটনের কাছে পরাস্ত তিনি। এরপরও নেই ছেলে সন্তান। এর ফলে এখন সরকারি আর ব্যক্তি সাহায্য সহযোগিতার উপর নির্ভর এই পরিবার ।
দিনমজুর সয়ান আলী টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাঘিল ইউনিয়নের ফৈলার ঘোনা গ্রামের মৃত. আয়ান আলী শেখের ছেলে।
দিনমজুর সয়ান আলী বলেন, দাদা, বাবা আর তার উপার্জনে কোন জমিজমা করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে তাদের তিন প্রজন্মেরই ঠিকানা দাদার বাবা (তাওই)এর গড়া বাড়ি। তাওইয়ের ছিল তিন ছেলে সন্তান। যার একজন তার দাদা বহর আলী শেখ। এই বাড়িতে বসবাস, জমিজমায় চাষাবাদ আর দিনমজুর করে সংসার চালিয়েছেন তার দাদা বহর আলী শেখ।
দাদার অভাব অনটনের সংসারেও জন্ম নেন তার বাবা আয়ান আলী শেখসহ তিন ছেলে সন্তান। দাদার বয়স বৃদ্ধির কারণে দিনমজুর করে সংসারের হাল ধরেন তার বাবা আয়ান আলী শেখসহ দুই চাচা। তাদের পরিশ্রমে টিনের এই ঘরটুকু যোগ হলেও বাড়েনি জমিজমা। বাবা আয়ান আলী শেখের ঘরে জন্ম নেন সয়ান আলী শেখসহ তিন ছেলে সন্তান। বাবার মৃত্যুর পর তাদের দাদার বাবা (তাওইয়ের) কাছ থেকে পাওয়া জমিজমা ভাগ করে নেন সয়ান আলী শেখসহ তিনভাই। ভাগ বাটোয়ারায় সয়ান আলী শেখের জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৫ শতাংশের বাড়ি আর ১১ শতাংশ আবাদী জমি। সয়ান আলীর পাওয়া এই সম্পতি আর দিনমজুরী করা সংসারে জন্ম নেয় তিন কণ্যা সন্তান।
তিনি বলেন, আবাদী ওই জমিতে নিজ পরিশ্রমে পাওয়া ফসল আর দিনমজুরী করে উপার্জিত টাকায় এক এক করে তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার মত সুখ বেশিদিন দীর্ঘ হয়নি সয়ান আলীর। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই বড় মেয়ের মৃত্যু আর গত তিন বছর আগে ছোট মেয়ের স্বামীর মৃত্যুর মত দুঃসংবাদ সইতে হয়েছে তাকে। সয়ান আলীর স্বামী-স্ত্রীর সংসারে বর্তমানে যোগ হয়েছে দুই সন্তানসহ স্বামীহারা ওই মেয়ে।
একদিকে বার্ধক্য অপরদিকে স্বামীহারা মেয়েসহ দুই সন্তানের লালন পালনের ব্যয়ে দিশেহারা হয়ে উঠেছেন দিনমজুর সয়ান আলী। এর মাঝেও হানা দিয়েছে বিশ্ব মহামারী করোনা।
তিনি আরো বলেন, বয়সকালে মাটিকাটা আর কৃষিকাজের দিনমজুর ছিলেন। এখন বয়স বাড়ার কারণে সব কাজ করতে পারেননা তিনি। তবে সংসারের প্রয়োজনে এখনও মাটিকাটা আর কৃষিকাজের দিনমজুরী করে যাচ্ছেন তিনি। এখন ঠিক মত কাজ করতে না পারায় তার দিনমজুরী আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা। দিনমজুরীর পাশাপাশি মানুষের গরু বর্গা নিয়ে লালন পালনও করেন তিনি।
দিনমজুর সয়ান আলী শেখ আরো বলেন, করোনা আসার পর থেকে কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া আড়াই হাজার টাকা পাননি তিনি। তবে এ সময় স্থানীয় বেশ কিছু ত্রাণ সহায়তা পেয়েছেন। এই ত্রাণ সহায়তা না পেলে মারা পরতেন তারা। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাচ্ছেন দশ টাকার চাল আর চলছে তার বয়স্কভাতার কার্ড করে দেয়ার প্রস্তুতি।
সয়ান আলী শেখের অসুস্থ স্ত্রী বিমলা বেগম (৬০) বলেন, স্বামীর বয়স হওয়াসহ সংসারে কোন ছেলে সন্তান না থাকায় চরম কষ্টে চলছে তাদের জীবনযাপন। ভাঙা এক টুকরো টিনের ঘরে স্বামী-স্ত্রীসহ স্বামীহারা মেয়ে ও তার দুই সন্তান নিয়ে এখন তাদের বসবাস। করোনায় সকল প্রকার কাজ বন্ধ থাকায় গ্রামবাসির পক্ষ থেকে দেয়া বেশ কিছু ত্রাণ পান তারা।
সয়ান আলী শেখের স্বামীহারা মেয়ে শরিফন বেগম (৩২) বলেন, গত তিন বছর আগে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় আমার স্বামী মারা যান। বর্তমানে দুই সন্তান নিয়ে দিনমজুর বাবা সয়ান আলীর বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া আড়াই হাজার টাকা পাননি তারা। পাননি ভিজিএফ কার্ডও।
গ্রামের মাতাব্বর আব্দুল খালেক (৬৫) বলেন, অতিদরিদ্র ব্যক্তি দিনমজুর সয়ান আলী শেখ। তিনি ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছেন সয়ান আলী শেখের দিনমজুরীর জীবনযাপন। তার দাদা আর বাবাও করতেন এই দিনমজুরী বলেও জানান তিনি।
বাঘিল ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড ফৈলার ঘোনা গ্রামের ইউপি সদস্য শামসুল আলম বলেন, আমার ওয়ার্ডের হতদরিদ্র ও দিনমজুর ব্যক্তি সয়ান আলী শেখ। এছাড়াও বার্ধক্যজনিত কারণে এখন ভালো মত দিনমজুরীর কাজও করতেন পারেন না তিনি। এ কারণে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দশ টাকা কেজি দরের চালের কার্ড করে দেয়াসহ তাকে বয়স্কভাতার কার্ড করে দেয়া হয়েছে।
বাঘিল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম সোহাগ বলেন, করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া আড়াই হাজার টাকার জন্য এ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ১ হাজার জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছিল। তবে ওই টাকার বন্টন তালিকা উপজেলা পরিষদ থেকে পাঠানো হয়। এ ইউনিয়নের কত জন ওই তালিকায় ছিল সে তথ্যও আমাদের দেয়নি উপজেলা প্রশাসন বলেও জানান তিনি।
মিটিংয়ে থাকায় টাঙ্গাইল সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহজাহান আনছারী বক্তব্য গ্রহণ করা যায়নি।
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি
আপনার মন্তব্য লিখুন...