টাঙ্গাইলের গোপালপুরে এক যুদ্ধাপরাধীর পুত্র স্থানীয় আওয়ামী লীগের ছত্রছাঁয়ায় চাতুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসাবে চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও সরকারি দলের নেতারা মুখ খুলছেন না। বিস্মিত এলাকাবাসি।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কীভাবে একজন যুদ্ধাপরাধীর পুত্র বিপুল অঙ্কের টাকা উৎকোচ দিয়ে চাকরি বাগিয়ে নিলেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
জানা যায়, চাতুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মনিরুজ্জামানের পিতা মৌলভী আব্দুর রহিম ছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মানুষ। নগদাশিমলা পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক থাকাবস্থায় ১৯৭০ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। গোটেংরা গ্রামের রাজাকার মৃত সফিউদ্দীন তালুকদারের দোসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পক্ষালম্বন করেন তিনি।
যুদ্ধকালীন সময়ে কমান্ডার হুমায়ুন বেঙ্গল হানাদার বাহিনীর পক্ষালম্বন করা এই মৌলভী আব্দুর রহিমকে গ্রেফতার করার জন্য তার গোটেংরার বাড়িতে অভিযান চালান।
পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সেদিন বীরমুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হুমায়ুন বেঙ্গল বাহিনীর সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। সেই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের সামনে টিকতে না পারলে রণে ভঙ্গ দেয়। এ সুযোগে পাক হানাদার বাহিনী পলশিয়া গ্রামের রাজাকার আবুল সরদার, মাহমুদপুর গ্রামের মহিরউদ্দীন কুঠাল এবং ইন্তাজ আলীর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি হাতেম আলী তালুকদারের বাড়িতে অগ্ন্ িসংযোগ করে এবং জননেতা হাতেম আলী তালুকদারের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হায়দার আলী তালুকদারকে আটক করে পানকাতা গ্রামের মোড়ে নিয়ে গুলি করাসহ বেনয়েট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
সেদিন শহীদ হায়দার তালুকদার সাথে আরো বাইশজনকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।
শহীদ হায়দার তালুকদার গোপালপুর উপজেলা শিক্ষক সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম তালুকদারের পিতা এবং গোপালপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক তুখোড় ছাত্রনেতা সাইফুল ইসলাম সুরুজ এবং জেলা পরিষদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল কাদের তালুকদারের আপন চাচা।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত পানকাতা হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং মাহমুদপুর গ্রামের বাসিন্দা লুৎফর রহমান জানান, সে দিনটি ছিল এক বিভীষিকাময় দিন। অনেকে সে সব দিনের কথা ভুলে গিয়ে স্বার্থপরের মতো শত্রæদের বুকে তুলে নিলেও তিনি এখনো সেই স্মৃতি ভুলতে পারেননি। এখনো প্রতি বছর মাহমুদপুর বাজারে গণহত্যা দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
মাহমুদপুর গ্রামের সে দিনের ঘটনায় ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি দালাল আইনে মামলা হয়। গোপালপুর থানার মামলা নং ০৩, তারিখ ৩০.০১.১৯৭২। পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে চালান দেন। টানা আট মাস জেলহাজত খাটার পর ১৯৭২ সালের নয় সেপ্টেম্বর মৌলভী আব্দুর রহিম জামিনে মুক্তি পান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সুবাদে মৌলভী আব্দুর রহিম রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে যুদ্ধাপরাধ মামলা থেকে খালাস পেয়ে পানকাতা হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সম্প্রতি তিনি ইন্তেকাল করেন। মরণের আগ পর্যন্ত তিনি জামায়াত-বিএনপির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এছাড়া মৌলভী আব্দুর রহিমের পুত্ররা সবাই ছাত্রদল এবং বিএনপি’র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বড় পুত্র মনিরুজ্জামান ছিলেন কাহেতা গার্লস হাইস্কুলের সহকারি শিক্ষক।
গত বছর চাতুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খাদেমুল ইসলাম বাবুল এবং স্কুলের গভর্নিং বডির সাবেক সভাপতি ফিরোজ আকন্দকে প্রায় বারো লক্ষ টাকা উৎকোচ দিয়ে চাতুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে মৌলভী আব্দুর রহিমের পুত্র মনিরুজ্জামান এর বিরুদ্ধে। আর ঘুষের বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীর পুত্রকে জায়েজ করেন প্রধান শিক্ষক খাদেমুল ইসলাম।
নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রধান শিক্ষককে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছে হাদিরা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ শাখার একটি অংশের উপর। তারাও টাকার ভাগ পেয়েছে বলে জানা গেছে।
হাউলভাঙ্গা গ্রামের আওয়ামীলীগকর্মী এবং জয় স্পোর্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মনিরুজ্জামান মিল্টন নিয়োগ প্রক্রিয়ার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, চাতুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জননেতা হাতেম আলী তালুকদার। অথচ আজ সেই স্কুলে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে চাকরি নিয়েছেন একজন যুদ্ধাপরাধীর পুত্র।
বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহযোগি মরহুম হাতেম আলী তালুকদারের ভাই হায়দার আলী তালুকদারকে হত্যাকারী এবং তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগকারী মৌলভী আব্দুর রহিমের বশংবদরা, যারা বিএনপি বা জামায়াত সমর্থক হিসাবে চিহ্নিত, তারা কিভাবে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের যোগসাজশে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি তদন্তেরও দাবি জানান তিনি।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ওই ইউনিয়নের আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের দুই নেতা মাদকাসক্ত। এক ছাত্রলীগ নেতা মাদক ব্যবসার অভিযোগে বেশ কয়েকবার জেলহাজতেও যান। রাজনৈতিক ছত্রছাঁয়ায় তারা এখনো এলাকায় মাদক ব্যবসা করেন। আর এসব অবৈধ কাজে নেতাদের কৌশলে ম্যানেজ করেছেন যুদ্ধাপরাধীর পুত্র মনিরুজ্জামান। আর এক ছাত্রলীগ নেতার দাপট ও সহযোগিতায় বুক ফুলিয়ে চলছেন মনিরুজ্জামান।
শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে এক শ্রেণীর হাইব্রিড নেতাদের টাকার বিনিময়ে একাত্তরের শহীদদের সাথে বেইমানী করে যুদ্ধাপরাধী পুত্রকে সহকারি প্রধান শিক্ষক বানানোর রৎস উন্মোচন ও জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছে এলাকাবাসী।
এ ব্যাপারে জেলা পরিষদ সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল কাদের তালুকদার জানান, তিনি চাতুটিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি হবার আগে এসব দুস্কর্ম হয়েছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে মৌলভী আব্দুর রহিমের ভূমিকা থাকার সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, আজ কেন যেন চালডাল মিশে গেছে। এসব এখন আলাদা করে বাছাই করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ওয়ার ক্রাইমস ইনকোয়ারী কমিটি একাত্তর যৌথভাবে তদন্ত করলে যুদ্ধাপরাধীর ঘটনা এবং ঘুষ বাণিজ্য উভয়ের সত্যতা মিলবে। কারণ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন এমন বহুমানুষ এখনো চাতুটিয়া ও হাউলভাঙ্গা গ্রামে বেঁচে আছেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব কিছুর প্রমাণ মিলবে। পাশাপাশি এখানকার মাদকচক্রকে ভেঙ্গে দিতে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হুমায়ুন বেঙ্গল স্মৃতি হাতড়ে বলেন, এসব সত্য ঘটনা আজ ধামাচাপা পড়েছে। তবে সে সব ঘটনা খুঁজে বের করতে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উল্লেখ্য, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭২ সালের জানুয়ারী মাসে মৌলভী আব্দুর রহিম দালাল আইনে আটক হন। তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পাকহানাদার বাহিনীর দ্বারা সাবেক এমপি জননেতা মরহুম হাতেম আলী তালুকদারের বাড়িতে অগ্ন্সিংযোগ ও মাহমুদপুর গ্রামে গণহত্যার সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়।
তপু আহম্মেদ
প্রকৌশলী সজল আহমেদ
সবুর খান টাওয়ার, বড় কালিবাড়ী রোড, টাঙ্গাইল-১৯০০
সেল: ০১৭১৯ ৯৬০ ৫৮৯/ ০১৯১১ ৬১৫ ৯৫৬, নিউজ রুম সেল: +৮৮ ০১৮৪৫ ৯৬৭ ২০১, +৮৮ ০১৮৪৫ ৯৬৭ ২০২
ই-মেইল: news.tangail24@gmail.com, এডিটর ইন চীফ ই-মেইল: topuahmed@gmail.com
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি
আপনার মন্তব্য লিখুন...