বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। দীর্ঘ নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল এদেশে। দীর্ঘ এই নয় মাসে ত্রিশ লাখ নিরীহ মানুষ হত্যা করেছিল পাক হানাদার বাহিনী।
মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সেইসব শহীদদের স্মৃতি চির জাগরুক রাখতে দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিসৌধ ও ভাস্কর্য। তেমনি টাঙ্গাইলের সখীপুরেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বহেড়াতৈল নামক স্থানে শপথস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল এবং এটিই বাংলাদেশে একমাত্র শপথস্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত ছিল বলে উদ্যোগ গ্রহণকারী কাদেরিয়া বাহিনীর পক্ষ থেকে জানা গেছে।
সখীপুর সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে কচুয়া-আমতৈল-বহেড়াতৈল সড়কের বহেড়াতৈল বাজারের পাশেই নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে শপথস্তম্ভ। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণউৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে ১৯৯৮ সালে শপথস্তম্ভের উদ্বোধন করার কথা ছিল। তৎকালীন সংসদ সদস্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তমের উদ্যোগেই শপথস্তম্ভটি নির্মিত হয়েছিল।
বিশাল উচ্চতার শপথস্তম্ভটি নির্মিত হওয়ার কথা থাকলে তা হয়নি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শপথস্তম্ভটি উদ্বোধন করার কথা থাকলেও নানা কারণে সেটি হয়নি।
জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতিকে ধরে রাখতে ১৯৯৬ সালে টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের অর্থায়নে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম শপথস্তম্ভটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ শপথস্তম্ভ¢টি উদ্বোধন করার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় সেটি আর সম্ভব হয়নি।
এরপর দীর্ঘ ২৩ বছর পেরিয়ে গেলেও শপথস্তম্ভটির নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। অযতœ আর অবহেলায় পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এ শপথস্তম্ভটি। ধাপে ধাপে উঠে বিশাল উচ্চতার শপথস্তম্ভটি আর বিশাল হয়নি। ছোটই রয়ে গেছে। উঁচুনিচু টিলা আকৃতির জায়গার উপর বিস্তৃত সবুজ ঘাসের গালিচায় আবৃত শপথস্তম্ভটি দেখতে দারুণ। লাল ইটের রাস্তা সমৃদ্ধ এই শপথস্তম্ভটি ভ্রমণকারীদের আকর্ষণ করে। শপথস্তম্ভটির চত্ত্বরের পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গণকবর।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত অন্যতম বহেড়াতৈলে ১৯৭১ সালের ১০ জুন কাদেরিয়া বাহিনীর অগণিত মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে পবিত্র কোরআন, বাইবেল ও গীতা ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করেছিল। ১৯৭১-এর এ ঘটনাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৮ সালে সেখানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ উদ্বোধন করার কথা ছিল শপথস্তম্ভটি। এছাড়াও এখানে বিশ্রামাগার, কবরস্থান, মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘরসহ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। শপথস্তম্ভটির নকশায় নানা বৈচিত্র্য ও স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য, উদীয়মান সূর্যের প্রতীকসহ শহীদের স্মৃতিকে স্মরণ করে রাখতে বহুমুখি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
এছাড়াও বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নিদর্শন ও স্মারকচিহ্নসমূহ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শন, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য, প্রমাণাদি, নিদর্শন, রৈকর্ডপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে এখানে জাদুঘরে রাখা হতো। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একাধিক গ্যালারির ব্যবস্থা থাকতো। গ্যালারিগুলোতে প্রদর্শিত হতো বাঙালির ঐতিহ্যের পরিচয় এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের চিহ্ন। দেশভাগ-পরবর্তী পাকিস্তানি শাসন-শোষণের ইতিহাস।
৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’য়ের গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১’য়ের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিমূর্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হতো চার দেয়ালের মুর্যালে। একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, ২৫শে মার্চ সংঘটিত গণহত্যা, স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও শরণার্থীদের জীবনচিত্র। প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার নারী পুরুষের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ. পাকিস্তান সেনা ও তাদের দোসরদের বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং বাঙালির বিজয় দৃশ্য।
সখীপুৃর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার এসএমএ মোত্তালিব বলেন, কাদেরিয়া বাহিনীর হয়ে ১৯৭১ সালের ১০ জুন দেশ স্বাধীনের লক্ষ্যে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেদিন বহেড়াতৈলে কোরআন, বাইবেল ও গীতা ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিল।
সেদিন তিনিও শপথ নিয়েছিলেন জানিয়ে আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনাস্থল বহেড়াতৈলকে ঘিরে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটি বাস্তবায়ন হলেন স্থানটি প্রজম্মের জন্য ও দেশের মধ্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকতো। শপথস্তম্ভটি মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের আরও প্রতীক হয়ে থাকতো।
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি
আপনার মন্তব্য লিখুন...