০৩:১২ পিএম | টাঙ্গাইল, শনিবার, ৪ মে ২০২৪
প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া

৪৮ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পায়নি শহীদ হাবিবুর রহমানের পরিবার

স্টাফ রিপোর্টার | টাঙ্গাইল২৪.কম | শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯ | |
, টাঙ্গাইল :

মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার রত্নগর্ভা টাঙ্গাইল,জেলার কালিহাতীতে জন্মেছেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, গেরিলা যুদ্ধের কিংবদন্তি কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাজাহান সিরাজ, বেসামরিক প্রধান আনোয়ার উল আলম শহীদ ও নারী সংগঠক হাজেরা সুলতানাসহ অনেক দুঃসাহসিক মুক্তিযোদ্ধা। 

যারা দেশ মাতৃকাকে হানাদারমুক্ত করতে পিছপা হননি, জীবনবাজি রেখে লড়েছেন। অনেকে হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করেছেন প্রিয় জন্মভূমিকে স্বাধীন করতে। শহীদ হাবিবুর রহমান তেমনি একজন অকুতোভয় যোদ্ধার নাম। 

বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছে ছিল আতংক। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রায় ১৭ হাজার মুক্তিযোদ্ধা, অর্ধ শতাধিক কোম্পানী কমান্ডার এবং ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে গঠিত হয় বিশাল কাদেরীয়া বাহিনী। তারা মুক্তিযুদ্ধে ১১নং বিশেষ সেক্টরে নিয়োজিত ছিলেন। এই বাহিনীর যোদ্ধারা ৩ শতাধিক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং প্রায় ৩০০০ হানাদার সদস্য হত্যা করেন। ১১ ডিসেম্বর কাদেরীয়া বাহিনীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ও তার বাহিনীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কাদেরীয়া বাহিনীর কোম্পানী কমান্ডারের দায়িত্বপালন করেছেন যে ক’জন ব্যক্তি তাদের মধ্যে একমাত্র শহীদ কোম্পানী কমান্ডার হলেন হাবিবুর রহমান। 

শহীদ হাবিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কালিহাতী উপজেলার দূর্গাপুর ইউনিয়নের চরসিংগুলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজিম উদ্দিন এবং মাতার নাম জবেদা খাতুন। শিক্ষাজীবনে হাবিবুর রহমান ১৯৬৭ সালে এসএসসি, ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন।

বিএ অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার নেশায় বিভোর হয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। ভারতের তেলঢালা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ করেন। কাদেরীয়া বাহিনীর অধীনে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে হাবিবুর রহমানকে কমান্ডার নিযুক্ত করে গঠন করা হয় হাবিব কোম্পানী । তাঁর কোম্পানী সেকেন্ড ইন কমান্ড (টুআইসি) ছিলেন একই এলাকার নুরুল ইসলাম মাস্টার। 


হাবিবুর রহমান শহীদ হবার পর তিনি কোম্পানির কমান্ডারের দায়িত্ব পান। এছাড়া প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন কালিহাতী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের সিংগুলী গ্রামের লুৎফর রহমান, বেরিপটলের আব্দুল আজিজ সিকদার, টাঙ্গাইল সদরের মোকাদ্দেস আলী, গোপালপুর উপজেলার মজিবর রহমান ও ময়মনসিংহের সাফায়েত হোসেন। ১১নং সেক্টরের টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর ও শেরপুর জেলার বিভিন্নস্থানে কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানীদের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়।

১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সমেশপুর গ্রামে হাবিব কোম্পানীর সাথে পাকিন্থানী হানাদার বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ চলছিল। একপর্যায়ে হানাদার বাহিনীর ছোড়াগুলি হাবিবুর রহমানের কপালে লেগে তিনি শাহাদৎ বরণ করেন। 


হাবিব কোম্পানীর সহযোদ্ধা কালিহাতী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সাংগঠনিক কমান্ডার আব্দুল হাই আকন্দ স্মৃতিচারণ করে বলেন সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সমেশপুর এলাকায় আমরা ক্যাম্প করি। নিয়মিত টহল ডিউটি শুরু হয়। সমেশপুর এমন একটি জায়গা যার নিকটেই সিরাজগঞ্জ, দক্ষিণে সোহাগপুর এবং পশ্চিমে উল্লাপাড়া রেলষ্টেশন। তিন পয়েন্টেই পাকিস্থানী হানাদার,রাজাকারদের শক্তঘাঁটি। আমাদের ক্যাম্পে ওরা আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে আমরা সেটা বুঝতে পারিনি।

এই ক্যাম্প থেকেই বিভিন্নস্থানে আমাদের যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ থেকে এসে সোহাগপুর হাটে ঢোল দিয়ে শুকুর মাহমুদ নামের এক লোক মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট বিক্রি করে। শুকুর মাহমুদের গতিবিধি সন্দেহ হওয়ায় আমাদের একজন ডিউটিযোদ্ধা কমান্ডার হাবিবুর রহমানের নিকট ওকে ধরে নিয়ে আসেন। তখন শুকুর জানায় সে অত্যান্ত গরীব, ভিটামিন বিক্রি করেই সংসার চলে। 


এলাকার লোকজন  ওকে ভাল মানুষ বলেই সাফাই গায়। সবার অনুরোধে কমান্ডার সাহেব শুকুরকে ছেড়ে দেন এবং অবাধে চলাফেরা করার অনুমতি প্রদান করেন। কিন্তু ও’যে একজন রাজাকার, হানাদার বাহিনীর দোষর এবং সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করছে আমরা কেউই বুঝতে পারি নাই। এভাবেই চলে কিছুদিন । ১৯৭১’র ৭ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় শুকুরমামুদ সোহাগপুর থেকে সিরাজগঞ্জ যাচ্ছে। জহের আলী নামের আমাদের একজন সহযোদ্ধা সমেশপুরের দক্ষিণ এলাকায় ডিউটিরত অবস্থায় ওকে দেখতে পান। 

এতভোরে শুকুর কোনদিন চলাফেরা করে না। জহের আলী সন্দেহ নিয়ে ডাক দিলে ও দ্রুত চলে যেতে থাকে। জহের আলী দৌঁড়ে গিয়ে শুকুরকে ধরে ফেলে। ওর কাছে সমেশপুর এলাকার একটি ম্যাপ ও চিঠি পাওয়া যায়। এসব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে শুকুর মামুদ বলে ভাই আমাকে স্যারের কাছে নিয়ে যান। পরে কমান্ডারের কাছে নিয়ে আসা হয়। কিছু মারপিট দেওয়ার পর ও কমান্ডারের দুপা জড়িয়ে ধরে বলে স্যার আপনারা বাঁচুন।

সকাল ৭টায় তিন দিক থেকে আপনাদের উপর আক্রমন চালাবে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী। তখন কমান্ডার আমাদেরকে তিন দিকে ডিফেন্স পজিশন নিতে বললেন। আমরা প্রস্তুত হই। ঠিক ৭টায় আক্রমন চালালো হানাদাররা। দুই পক্ষের মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ। কিন্তু আমরা পূর্বেই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় আমাদের তেমন ক্ষতি হলনা। আমরা জয়ের দাঁড়প্রান্তে । 

এমন সময় কমান্ডার হাবিবুর রহমান যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে নির্দেশ দিতেই হানাদারদের ছোড়া গুলি তাঁর কপালে লেগে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রক্ত ঝড়তে ঝড়তে আমাদের চোখের সামনেই কমান্ডার হাবিবুর রহমান শাহাদৎ বরণ করেন। আমরা মইয়ের উপর শুইয়ে রেখে সমেশপুর থেকে পায়ে হেঁটে সিংগুলী আনার পর তাঁকে দাফন করি। এ যুদ্ধে আরো ৪জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সেইসাথে বেশ কয়েকজন হানাদার, রাজাকার  নিহত ও আহত হয়েছিল। সেইদিনগুলি আজও চোখে সামনে জল জল করে ভেসে উঠে।

পারিবারিক জীবনে হাবিবুর রহমান জাহানারা বেগমকে বিয়ে করেন। একছেলে মৃত নজরুল ইসলাম। একমেয়ে নার্গিস আক্তার আমিনা বলেন আব্বা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর আমরা অনেক কষ্টে বড় হয়েছি। আম্মা গত বছর (২০১৮) মারা গেছেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নিজেকে সর্বদাই গর্বিত মনে করি। বর্তমানে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পেলেও আমরা শহীদ পরিবার হিসেবে ভাতা কিংবা কোন সুযোগ সুবিধা পাচ্ছিনা। 

শহীদ হাবিবুর রহমানের স্মরণে সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের সমশেপুরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা একটি রাস্তার নামকরণ এবং একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করেছেন। কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার জানান তিনি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে কালিহাতীর এলেঙ্গা থেকে পটল যাবার সড়কটি শহীদ হাবিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
 
হাবিবুর রহমানের ভাতিজা অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম-সচিব মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম বলেন হাবিব চাচা আমাদের এলাকার যুবকদেরকে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য উৎসাহিত করতেন। আমরা তার নেতৃত্বেই প্রশিক্ষণ নিতে নৌকাযোগে ভারতে গিয়েছিলাম এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। 

হাবিবুর রহমান সম্পর্কে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি মুক্তিযুদ্ধে কাদেরীয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেছেন তিনি একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে শহীদ হওয়ার খবর শুনে আমি হাবিবুরের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমাদের বাহিনী এবং টাঙ্গাইলে শহীদ হওয়া কোম্পানি কমান্ডার তিনি। 

অনেক মুক্তিযোদ্ধাই বলেছেন শহীদ হাবিবুর রহমান ছিলেন এক অকুতোভয় যোদ্ধা, দেশের জন্য তার জীবন দানে আমরা গর্বিত। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিবারকে ভাতা ও সম্মান প্রদানের দাবি জানিয়েছেন তার সহযোদ্ধাগণ।

যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন শ্রদ্ধাভরে এ জাতি স্মরণ করবে হাবিবুর রহমানের নাম।

আপনার মন্তব্য লিখুন...

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে গণমাধ্যমকর্মীদের সমাবেশ  গুচ্ছ ‘বি’ ইউনিট ভর্তি পরীক্ষায় মাভাবিপ্রবি কেন্দ্রে উ মির্জাপুরে রাতের আঁধারে কৃষি শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা নাগরপুরে দু''পক্ষের সংঘর্ষে বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নি সখীপুর বনে দুর্বৃত্তের আগুন, বিলুপ্ত হচ্ছে বন্য প্রাণী কালিহাতীতে মে দিবস পালিত মেয়ে ও জামাতার বিরুদ্ধে বাবাকে নির্যাতনের অভিযোগ, বৃদ্ধ প্রধান শিক্ষককে বাড়িতে ডেকে নিয়ে মারধর, থানায় মামলা গোপালপুরে বিদেশ ফেরত পুনরেকত্রীকরন শীর্ষক কর্মশালা নাগরপুরে খাদ্যভিত্তিক পুুষ্টি (ফলিত পুষ্টি) বিষয়ক প্রশি করটিয়া হাটে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন মেয়ের বাড়ি বেড়াতে এসে লাশ হলেন বাবা ৫০০ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৪ নেতা গোপালপুরে হিটস্ট্রোকে চা বিক্রেতার মৃত্যু  নাগরপুরে বালুবাহী ট্রাক্টর কেড়ে নিল যুবকের প্রাণ

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি