রাজধানীর সাথে সড়ক পথে উত্তরবঙ্গের একমাত্র প্রবেশপথ বঙ্গবন্ধু সেতু। আর এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ২৬ টি জেলার যানবাহন চলাচল করে। ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যমুনা নদীর ওপর স্থাপিত বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে যত দিন যাচ্ছে এ সেতুতে যানবাহন পারাপারের সংখ্যা ততই বাড়ছে।
উদ্ভোধনের ১৩ বছর পর প্রথম বাড় বাড়ানো হয় সেতুর টোল। এরপর প্রায় ৫বছর পর স¤প্রতি বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের হার আবারও বাড়ায় সেতু বিভাগ। এর কিছুদিন আগে টোল বিভাগের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন হয়।
এরপর থেকেই দেশের সর্ববৃহৎ বঙ্গবন্ধু সেতু’র যানবাহন পারাপারের টোল আদায়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। টোল আদায়ে নিয়োজিত নতুন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস) কাজ শুরু করার পর থেকেই এ চুরির মহোৎসব চলছে। টোল আদায়ের কাজ থেকে লোপাটকৃত অর্থ সেতুতে কর্মরত বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটি (বিবিএ) ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড (সিএনএস) এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং টোল আদায়কারীরা ভাগ করে নিচ্ছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এতে করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু সেতু রক্ষনাবেক্ষন ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত সাবেক এমসিসিসি-এসইএল-ইউডিসি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সেতুটির রক্ষনাবেক্ষনের জন্য নতুন করে কমিউনিকেশন কন্সট্রাকশন কোম্পানী অব চায়না (সিসিসিসি) কে দায়িত্ব দেয়া হয়। এসময় সেতুর টোল আদায়সহ অন্যান্য কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য নতুন কোন কোম্পানী নিয়োগ না হওয়ায় এর দায়িত্ব নেয় বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)।
পরে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারী দেশের সর্ববৃহৎ এ সেতু’র যানবাহন পারাপারের টোল আদায়ে ৬ মাসের জন্য দায়িত্ব পায় কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস)। এ কোম্পানী দায়িত্ব নেওয়ার পর বিবিএ প্রধান প্রকৌশলী মো. কবীর আহমেদের স্বাক্ষরিত একটি চিঠি ইস্যূ করার প্রেক্ষিতে পূর্বে স্থাপিত সিস্টেম পরিবর্তন করে সেতুটির পূর্ব ও পশ্চিমে সিএনএস কোম্পানীর মুক্তারপুর সেতুতে স্থাপিত ‘সফটওয়্যার রিয়েল টাইম অনলাইন ওয়েব বেইজড মর্ডান টোল কালেকশন সিস্টেম’ নামের নতুন সফটওয়ারটি বঙ্গবন্ধু সেতুতে স্থাপনের জন্য এক মাসের সময়সীমা দেয়া হয়। নতুন সফটওয়ার স্থাপনের জন্য বাড়তি কোন টাকা প্রদান করা হবে না বলেও জানানো হয় বিবিএ থেকে। সেতুতে নতুন সিস্টেম স্থাপনের কাজ শুরুর থেকেই ভোগান্তিতে পড়ে এই সেতু দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন। এসময় বেশ কয়েকদিন সেতুর টোলপ্লাজা এলাকায় দীর্ঘ যানজটেরও সৃষ্টি হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার সিস্টেম নেটওয়ার্ক (সিএনএস) দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই সেতুতে পূর্বে কর্মরত অর্ধশতাধিক টোল কালেক্টর, টোল সুপারভাইজার, অডিট কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে নতুন লোকবল নিয়োগ করে টোল আদায়ের কাজ শুরু করায় এ ভোগান্তি ও যানজট হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেলেও অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে নেপথ্যের অন্য চিত্র।
নতুন কোম্পানী দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাটাই আতঙ্কে পূর্বের টোল কালেক্টর, টোল সুপারভাইজার, অডিট কর্মকর্তারাসহ অর্ধশতাধিক লোকজন গত ৫ এপ্রিল অবস্থান ধর্মঘট পালন করার পর অনুসন্ধান চালিয়ে টোল আদায়ে ব্যাপক অনিয়ম ও অর্থ কারচুপির ঘটনা সামনে আসে।
অনুসন্ধানে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব টোল প্লাজার সিসি ক্যামেরার ভিডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার সিস্টেম নেটওয়ার্ক (সিএনএস) এর সফটওয়্যার প্রায়ই অচল হয়ে যাচ্ছে। এতে করে টোলপ্লাজা পাড় হওয়া যানবাহন আটকে পড়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। আর এ সুযোগে টোল আদায়ের দায়িত্বে থাকা এক শ্রেনীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়ম বর্হিভূত ভাবে অতিরিক্ত ও রশিদ বিহীন টাকা আদায় করছে। এছাড়া রশিদে টাকার পরিমাণ কম থাকলেও বেশি টাকা আদায়েরও তথ্য পাওয়া গেছে। যা সফটওয়্যারে হালনাগাদ করা হচ্ছে না। এতে করে প্রতিদিনই লোপাট হচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
দিন শেষে আদায়কৃত টাকার মধ্যে শুধু জমা হচ্ছে সফটওয়্যারে হালনাগাদ করা অর্থ। বাকি টাকা লোপাট করে ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সেতুতে কর্মরত বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটি (বিবিএ) ও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম লিমিটেড (সিএনএস) এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং টোল আদায়কারীরা। এতে করে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
অনুসন্ধানে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব টোল প্লাজার ১৬ মার্চ এর সিসি ক্যামেরার (W-Tool-B-02) বিকেল চারটা ৩৬ মিনিটের ভিডিও রেকর্ডিং এ দেখা যায়, একটি ট্রাকের এক হাজার ১০০ টাকার টোল নেওয়া হচ্ছে এক হাজার ২০০ টাকা। যদিও সেতুর টোল বৃদ্ধির হার অনুমোদন হয় ২৯ মার্চ।
২৩ মার্চ এর সিসি ক্যামেরার (21-East Tool) বিকেল পাঁচটা ২০ মিনিটের ভিডিও রেকর্ডিং এ দেখা যায়, সফটওয়্যার অচল হয়ে যাওয়ায় একটি প্রাইভেটকার টোল রশিদ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। এসময়ই একটি এ্যাম্বুলেন্স বিনা টাকায়, পেছন থেকে প্রাইভেটকারটিকে ওভারটেক করে টোল পার হওয়ার চেষ্টা করলে টোল আদায়কারীরা তার নিকট থেকে টাকা গ্রহণ করছে। কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সটিকে দ্রুত যেতে দেখে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মী বাধা দিলে টোল প্লাজা থেকে ছেড়ে দিতে বলে। পরে সেই নিরাপত্তাকর্মী টোল কাউন্টারে এসে টাকার দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। একই সময়ের টোল কাউন্টারের ভিতরের ক্যামেরার (E-Tool-B-01) ভিডিও রেকর্ডিং থেকে বিনা রশিদে টাকা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়।
এদিকে নিয়মবর্হিভূতভাবে যানবাহন থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ ছোট যানবাহন থেকে বেশি আর বড় যানবাহন থেকে কম টাকা নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা মিলে সিসি ক্যামেরার ভিডিও রেকর্ডিং-এ। ২৩ মার্চের অপরএকটি সিসি ক্যামেরার (E-Tool-B-01) সকাল নয়টা ৩ মিনিটের ভিডিও রেকর্ডিং এ দেখা যায় বড় ট্রাক ১৪০০ টাকার টোল হলেও মাত্র ১১০০ টাকায় সেই ট্রাকটি ছেড়ে দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব টোল প্লাজার ১৮ মার্চ এর সিসি ক্যামেরার (E-Tool-B-01) সকাল ১১টা ৩০ মিনিটের ভিডিও রেকর্ডিং এ দেখা যায় একটি কালো জিপকে অলিখিত রশিদ দিয়ে টোলের একটি তালিকা ফর্মে স্বাক্ষর নিয়েই কোন টাকা ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেতুর নিয়ম অনুযায়ী শুধুমাত্র সেতুর কাজে ব্যবহৃত যানবাহনই বিনা টাকায় ফর্মে স্বাক্ষর করে চলাচল করতে পারবে।
অপর দিকে টোল প্লাজার ৩০ মার্চ এর সিসি ক্যামেরার (E-Tool-B-01) রাত ২টা ৩২ মিনিটের ভিডিও রেকর্ডিং এ দেখা যায় ১৪০০ টাকা নিয়ে মাত্র একটি রশিদে দুটি ট্রাককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে একটি ট্রাকের নির্ধারিত টোলই হচ্ছে ১১০০ টাকা।
এ ব্যাপারে টোল আদায়ে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেমের (সিএনএস) টোল কো-অর্ডিনেটর মো. মুকিতুল কবীরের সাথে তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর এ যোগাযোগ করা হলে, পরে কথা হবে বলে তিনি মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
অপরদিকে বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট অফিসের বিবিএ সহকারি প্রকৌশলী মো. ওয়াশিম আলী জানান, নতুন সিস্টেমে টোল আদায়ের জন্য বিবিএ থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট অফিসে চিঠি ইস্যু করা হয়েছে। সে মোতাবেক সেতুতে নতুন সিস্টেম স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া তিনি কোন কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্রিজ অথরিটির (বিবিএ) প্রধান প্রকৌশলী মো. কবীর আহমেদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি।
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি
নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি
আপনার মন্তব্য লিখুন...