০৮:২৪ পিএম | টাঙ্গাইল, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া

তিনটি মহাকাব্য এবং একজন কাইয়ুম নিজামী

এম আর মাহবুব | টাঙ্গাইল২৪.কম | শনিবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৭ | | ১৬২
, টাঙ্গাইল :

কবি কাইয়ুম নিজামী। একজন কবি থেকে একজন মহাকবি। কাব্যচর্চা শুরু সেই ষাটের দশকে ছাত্রজীবনে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক। দেশ মাতৃকার গভীর টানে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে নিজ উপজেলায় শ্রেষ্ঠ শিক্ষক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি কৃষি ও সমবায় বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন জাপান থেকে। গড়ে তোলেন কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বৃক্ষ রোপন, কৃষি খামার স্থাপনসহ কৃষিশিক্ষায় অনবদ্য অবদান রাখেন। এ বিষয়ে দেশ-বিদেশে নানা সেমিনারে অংশ নিয়ে সুনাম অর্জন করেন।

সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তার দুর্ণিবার আকর্ষণ। এ পর্যন্ত কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে ৬টি আর উপন্যাসের সংখ্যা ৬৫টি। গীতিকার কাইয়ুম নিজামীর ‘বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ’ নামে গানের সিডি বের হয়েছে।

সবকিছু ছাপিয়ে একজন কাইয়ুম নিজামী আমাদের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার অবিস্মরণীয় তিনটি মহাকাব্যের জন্য। এ এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। এ এক ব্যতিক্রমী ও সাহসী উদ্যোগ। আমাদের সাহিত্য জগতের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায়, এক নবতর সংযোজন। এ অধ্যায়ে গৌরবদীপ্ত নির্মাতা একজন কাইয়ুম নিজামী।

মহাকাব্যের ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্যের নাম ‘গিলগামেশ’। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে মেসোপটেনিয়া ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সময়ে ইরাকের এক গ্রন্থাগারে কীলক লিপিতে লেখা প্রায় তিন হাজার ছত্রের এই মহাকাব্যে পাওয়া যায়।

জানা যায় ঐ সময় উরুক নগরে ‘গিলগামেশ’ নামে এক রাজা ১২৬ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। তার জীবন কাহিনী নিয়েই রচিত হয়েছিল বিশ্ব সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য। পরে মহা কবি হোমার, বাল্মীকি, কালিদাস, ফেরদৌসী, দান্তে, আলাওল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কায়কোবাদসহ এ সময়ের মহাকবির নাম শোনা যায়।

বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন সময়ে মহাকাব্য রচিত হয়েছে। ফার্সি ভাষায় শাহনামা, ইংরেজি ভাষায় প্যারাডাইস লষ্ট, সংস্কৃত ভাষায় মহাভারত, রামায়ণ, ভগবত পুরাণ, অন্যতম। বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যকে বিবেচনা করা হয়। বাংলা সাহিত্যে আরও যে সকল মহাকাব্য রচিত হয়েছে।

তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কায়কোবাদের মহা শ্বাশন, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর স্পেন বিজয় কাব্য, নবীন চন্দ্র সেনের ত্রয়ী মহাকাব্য রৈবতক, কুরুক্ষেত্র এবং প্রভাস, ইত্যাদি মহাকাব্য নিয়ে যুগে যুগে অনেকেই গবেষণা করেছেন। মহাকব্যের বিভিন্ন সংজ্ঞাও প্রদান করেছেন। সেই সুপ্রাচীনকালে মুখে মুখে প্রচলিত কবিতা সমগ্রকেও মহাকাব্য বলা হতো। মহাকাব্য নিয়ে প্রখ্যাত গবেষক হলেন আলবার্ট লর্ড এবং মিলম্যান প্যারী। আবার দার্শনিক এরিষ্টটল ও বিশ্বকবি বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরও মহাকাব্যের সংজ্ঞা নিরূপন করেছেন।

মহাকাব্য নিয়ে গবেষক, দার্শনিক, কবি ও চিন্তাবিদদের সংজ্ঞার আলোকে আমরা একটা সরল ধারণা পেতে পারি। সেই ধারণা অনুযায়ী বলা যায়- মহাকাব্য মানে মহাজীবনের বিশাল কাহিনী, কোন অবিস্মরণীয় সত্য ঘটনা, মহান ব্যক্তির বীরগাঁথা বীরের কাহিনীই এর ভিত্তি, বীরের মহাত্ম্য, তার বীরত্ব, অসামান্যত্ব-সব ধরা পড়ে একটি মহাকাব্যে। সেই সাথে থাকে জনপদের কাহিনী, বিশেষ একটি সভ্যতার ইতিহাস, থাকে লোকালয়ের গল্প। একজন মানুষের কাহিনী হয়েও অনেক মানুষের কাহিনি। ওই একজন যাকে আমরা বীর বলি, তিনি অনেক মানুষের প্রতিনিধি। তাছাড়াও মহাকাব্য হবে বিশালায়তন কাব্য, আকারে যেমন বড় মাহাত্বেও তেমন বড়। অথবা কোন পুরান সম্পৃক্ততা নিয়েও মহাকাব্য রচিত হয়।

আমার আলোচ্য বিষয় কবি কাইয়ুম নিজামীর অনবদ্য সৃষ্টি ‘টুঙ্গি পাড়ায় জন্ম তোমার’ ‘কন্যার নাম শেখ হাসিনা’ ‘হাজার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক তিনটি মহাকাব্য প্রসঙ্গে। মানবতা ও রাজনীতির মহা কবিকে নিয়ে মহাকাব্যের আদলে রচিত কাইয়ুম নিজামীর এই অবিস্মরণীয় কাব্যগ্রন্থটি কালের পরিক্রমায় মহাকাব্যের স্থান দখল করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

‘টুঙ্গি পাড়ায় জন্ম তোমার’ কাব্যগ্রন্থে কেন্দ্রীয় চরিত্র হচ্ছে হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ে যার বলিষ্ট, সাহসী ও ত্যাগী নেতৃত্ব তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে।

ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য, অবিভাজ্য। বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই রচিত হয়েছে ‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ কাব্যগ্রন্থটি। ৮১১ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি দু’ভাগে বিভক্ত। ৯ থেকে ৪৮০ পৃষ্ঠায় বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম, বংশ পরিচয়, জীবন-কর্ম, রাজনীতি, জীবনাবসানসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে একটি কবিতা।

৪৮১ পৃষ্ঠা থেকে ৮১১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ‘যে ছবি কবিতার কথা বলে’ শিরোনামে রচিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতাগুচ্ছ। বঙ্গবন্ধুর জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে রচিত কবিতাটি এ যাবৎকালে বঙ্গবন্ধুর ওপর সবচেয়ে বড় কবিতা বলে বিবেচিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একক ভাবে একজন কবির রচনায় ৮১১ পৃষ্ঠার বিশাল কাব্যগ্রন্থ নি:সন্দেহে এক ব্যতিক্রমী ও সাহসী পদক্ষেপ।

মহাকাব্য সম্পর্কে পÐিত ব্যক্তিরা বলে থাকেন, ‘ঐতিহাসিক মহাসত্য ঘটনা নিয়ে রচিত মহাকাব্যে রূপক বা ছদ্মনাম ব্যবহার অনাবশ্যক’ কাইয়ুম নিজামী উক্ত গ্রন্থে মহা কাব্যের সে নীতিই অনুসরণ করেছেন।

মহাকাব্যের নিয়মনীতি মেনেই তিনি তার কবিতায় বিররস, করুণরস ও প্রেমরসের প্রসার ঘটিয়েছেন। এ কাব্যের বহুল প্রচার ও প্রসার ঘটলে এটি বাংলা সাহিত্যের মহাকাব্য হিসেবে এবং কবি কাইয়ুম নিজামী মহাকবি হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনটি না ভাবার কোন কারণ নেই বলে আমার ধারণা।

কবি তার এ গ্রন্থে সাল, তারিখ উল্লেখসহ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন সঠিক ও সত্য ইতিহাসের আলোকে। কবি তার ছন্দে বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে কোন কল্পনা বা কাল্পনিক চরিত্রের সমাবেশ ঘটাননি।

আনন্দের সাথে কাব্যগ্রন্থটি একজন পাঠক পরিপূর্ণ বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারবে। উপলব্ধি করতে পারবে। এখানেই কবি কাইয়ুম নিজামীর সার্থকতা। আলোচ্য গন্থে কাইয়ুম নিজামী শব্দচয়নে কঠিন শব্দ প্রয়োগ না করে সহজ-সরল, সর্বজনবোধগম্য সাধারণ শব্দ প্রয়োগ করেছেন। এখানে কল্পকাহিনীর কোন স্থান নেই।

ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা প্রকৃত নাম, তারিখসহ উল্লেখ করেছেন কাব্যিকভাষায়। এ মহাকাব্যের মহা নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে তিনি তুলে ধরেছেন ঐতিহাসিক সত্য ঘটনার আলোকে। এতে কোনো কাল্পনিক, রূপক বা পৌরানিক কাহিনীর চরিত্র নেই। যারা এই কাব্যগ্রন্থে স্থান পেয়েছেন তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর সহচর, পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা।

কবিতায় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের পরিপূর্ণ চিত্র এবং জীবনাচার তুলে ধরতে বর্ণিত হয়েছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার প্রকৃত সৌন্দর্য, সমকালীন আর্থ-সমাজিক-রাজনৈতিক চিত্র, বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধসহ নানা প্রসঙ্গ। এ কাব্যগ্রন্থখানি উৎসর্গ করা হয়েছে‘বঙ্গবন্ধুর ভক্ত যারা’ তাদের উদ্দেশ্যে।

রাজনীতির মহাকবিকে নিয়ে রচনা করেছেন এই মহাকাব্য। এটা সামান্য কাজ নয়। এই অসামান্য ও অবিস্মরণীয় কাজের জন্য কাইয়ুম নিজামী চিরদিন বেঁচে থাকবেন বাংলার মুক্তিকামী বঙ্গবন্ধু ভক্ত মানুষের হৃদয়ে।

মহাকাব্যটি প্রকাশ করেছেন জায়েন পাবলিকেশন। প্রকাশক- আফরোজা নিজামী, প্রকাশকাল জুন, ২০১৫, প্রচ্ছদ করেছেন মো. আব্দুল মাজেদ, মুদ্রণে তিলোত্তমা মুদ্রণালয়, অন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম, সত্ত-আফরোজা নিজামী। ৮১১ পৃষ্ঠা বইটির মূল্য রাখা হয়েছে এক হাজার দুইশত টাকা মাত্র।

মহাকবি কাইয়ুম নিজামীর দ্বিতীয় মহাকাব্য ‘কন্যার নাম শেখ হাসিনা’। এই মহাকাব্যের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৫৬। যার জীবনগাঁথা নিয়ে এই গ্রন্থ তাঁর নাম শেখ হাসিনা। যিনি জাতির জনকের কন্যা থেকে জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রী এবং বিশ্বনেত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত।

উক্ত কাব্যগ্রন্থের ভ‚মিকায় কাইয়ুম নিজামী বলেন, ‘তার কষ্টকে বুকে লালন করে লেখার চেষ্টা করেছি’। এখানেই তার সার্থকতা। শেখ হাসিনার জন্ম, শৈশব, শিক্ষা, রাজনীতিসহ তার দু:খ-কষ্ট, হাসি-কান্না প্রাত্যাহিক জীবনাচার অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তথ্য ও সত্য ঘটনার আলোকে বর্ণিত হয়েছে। আলোচ্য মহাগ্রন্থে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার-পরিজনসহ নির্মম হত্যাকাÐের আবেগ তাড়িত বর্ণনা আছে। আছে শেখ হাসিনা দেশ প্রত্যাবর্তন করার পর একজন সর্বহারার হাহাকার।

‘বিমান বন্দর থেকে বনানী’ ‘টুঙ্গিপাড়ায় বাবার কবরে’ ‘সেই বাড়িটির স্মৃতি’ শীর্ষক কবিতায় কাইয়ুম নিজামী যে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন তা পাঠ করলে যে কেউ অশ্রæসজল ও শোকাভিভ‚ত হয়ে যাবেন। গ্রন্থটিতে এরকম অসংখ্য ছত্র রয়েছে যা আপনাকে আবেগতাড়িত করে তুলবে। কবি নিজেই বইয়ের ভ‚মিকায় শেখ হাসিনা সম্পর্কে লিখেছেন, জীবনে খুব বেশি হাসতে পারেননি, কেঁদেছেন বেশি, শেখ হাসিনার সেই দু:খভারাক্রান্ত কান্নার ইতিহাস উপস্থাপিত হয়েছে কবির সুনিপুন হাতের স্পর্শে যা আপনাকেও কাঁদাতে বাধ্য করবে।

আবার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়া, গণতন্ত্রের পক্ষে নিরন্তন সংগ্রাম, সাফল্যগাঁথাও বর্ণিত হয়েছে গ্রন্থের বিশাল কলেবরে। এই অধ্যায়ে পাঠকের সংগ্রামী চেতনাকে জাগ্রত করতে কবির ভ‚মিকা প্রশংসনীয়।

এসব ছাড়াও শেখ হাসিনার শৈশব, দূরন্তপনা, বাঙালিয়ানাকে যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি তার শিক্ষা, রাজনীতি ও নেতৃত্বকে উপস্থাপন করেছেন চমৎকার কাব্যিক সুষমায়। চিন্তায়, ধ্যানে, মননে, মগজে কবি গভীর ভাবে শেখ হাসিনার জীবন ও কর্মকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলেই এই মহৎ কাব্য রচনা সম্ভব হয়েছে।

কাইয়ুম নিজামীর সর্বশেষ মহাকাব্য ‘হাজার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’। মোট ৬টি খন্ডে ২৩০০ পৃষ্ঠায় এই বিশালায়তন মহাকাব্যে কবিতা সংখ্যা ১১১৮টি। সবগুলো কবিতাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা।

বঙ্গবন্ধু ব্যক্তি জীবনে ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। একজন খাঁটি বাঙালি। দেশ ও কালের গÐি পেরিয়ে তিনি পরিণত হয়েছেন মহামানবে। তিনি কবিতা পছন্দ করতেন। তার সংগ্রামের উৎস ছিল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাব্য ও সংগীত। সংগত কারণেই বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় ‘পায়েট অব পলিটিক্স’। এই রাজনীতির কবি ও মহাকবিকে নিয়ে অনেকেই কালোর্ত্তীর্ণ কবিতা লিখেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুর জীবন, পারিপার্শ্বিকতা, রাজনীতি, মৃত্যুসহ প্রতিটি স্তরের সূ² সূ² সত্য ঘটনা নিয়ে ১১১৮টি কবিতা রচনা এক বিরল ঘটনা। অত্যন্ত সহজ সাবলিল ভাষায় আলাদা আলাদা শিরোনামে লেখা কবিতাগুলো শুধু ইতিহাস নির্ভর তথ্যই নয়, এর প্রধান বৈশিষ্ট আবেগ, অনুভ‚তি।

কবিতাগুলো পাঠ করলে মনে হবে মহানায়কের এক মহাকাব্যিক দ্যুতি দীপ্তমান হচ্ছে কবিতায় পরতে পরতে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শত-সহ¯্র কবিতা লেখা হয়েছে তবে এই মহা নায়ককে নিয়ে মহাকাব্য লেখার উদ্যোগ নেয়া হয়নি কবি কাইয়ুম নিজামীর কর্ম রাজনীতি, জীবনাচার ও কবি সেই অনন্য ও ব্যতিক্রমী কবিপ্রতিভা যিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুটি মহাকাব্য রচনা করেছেন।

কবি মানস লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই তার জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও সাধনার মূল বিষয় ছিল সৃজনশীলতা। এই সৃজনশীলতার উৎসভ‚মি হলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বঙ্গবন্ধু তাঁর রক্ত মাংসেরই অংশ। একটি মহাকাব্য রচনার যোগ্য পাত্র হিসেবে তিনি বঙ্গন্ধুকেই ধ্যানজ্ঞান মনে করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক দু’টি মহাকাব্য রচনা করতে কবি কাইয়ুম নিজামী সারা জীবন সাধনা করেছেন, চেতনাকে লালন করেছেন যুগের পর যুগ। যদিও দু’টি মহাকাব্য রচনা অল্পদিনের ফসল কিন্তু কাইয়ুম নিজামীর মানস সরোবরে এর বীজ রোপিত হয়েছিল কাব্য রচনার সেই প্রাথমিক যুগে।

বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথম একজন কাইয়ুম নিজামী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম দু’টি মহাকাব্য রচনা করেছেন।

আমাদের বিশ্বাস এটি এক সময় সুধী সমাজে ব্যাপক আলোচিত হবে এবং ইতিহাসে স্থান করে নেবে। ইতোমধ্যে দেশের প্রখ্যাত কবি সাহিত্যিকরা কাইয়ুম নিজামীর তিনটি মহাকাব্য সম্পর্কে ইতিবাচক মূল্যায়ন করেছেন।

কাইয়ুম নিজামীর মহাকাব্যগুলো অ্যামিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, অধ্যাপক ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিকিসহ স্বনামধন্য আরও কয়েকজন গুণি ব্যক্তির সরাসরি মন্তব্য ও উদ্ধৃতি শুনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। কাইয়ুম নিজামীর বিশাল কর্মযজ্ঞের সাফল্য এবং মহাকাব্য হিসেবে তাদের দেয়া স্বীকৃতি নি:সন্দেহে এক তাৎপর্যময় ঘটনা।

একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে আমি দেখেছি কবি কাইয়ুম নিজামী এই তিনটি মহাকাব্য রচনা করতে গিয়ে কিভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ছেন। ইট পাথরে দেয়া শহরের কোলাহল ছেড়ে, পরিবার-পরিজন ছেড়ে বহুদিন কাটিয়েছেন সমুদ্রতীরবর্তী কক্সবাজারে, কাটিয়েছেন চট্টগ্রামের নিরব নিভৃত এলাকায় প্রকৃতির সান্নিধ্যে। যেখানে বসেই রচিত হয়েছে মহাকাব্যের বৃহদাংশ।

অবর্ণনীয় শ্রম, অপরসীম ত্যাগ আর কাজের প্রতি দুর্নিবার ভালোবাসা না থাকলে এরকম অবিস্মরণীয় ও মহৎ কাজ করা সম্ভব নয়। আত্মোৎসর্গী এই কবির মহাকর্মযজ্ঞ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ স ম আরেফিন সিদ্দিক ‘কন্যার নাম শেখ হাসিনা’ মহাকাব্যের প্রকাশনা উৎসবে কৌতুক করে হলেও যথাযথই মন্তব্য করেছিলেন ‘মহাকবি কাইয়ুম নিজামী আমার মনে হয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২৬ ঘণ্টাই কবিতা লিখেন’।

একজন কবি কাইয়ুম নিজামী বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ের গভীরে স্থান দিয়ে, অন্তর থেকে ভলোবাসা এবং তারই কন্যা বিশ্বনেত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে যে অমর সৃষ্টি সম্ভার গড়ে তুলেছেন তা নিশ্চয় অতুলনীয়।

মহাকাব্যের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইতোপূর্বে যে কথা বলা হয়েছে এর আলোকে কবি কাইয়ুম নিজামী এবং তার লেখা উপরোক্ত তিনটি মহাকাব্য প্রসঙ্গে বলা যায়, মহাকাব্যের প্রায় সবগুলো বৈশিষ্ট্যই এতে বিদ্যমান রয়েছে। মহাকাব্যের আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেমন- মহাকাব্য দীর্ঘ ও বিস্তৃত কবিতা। কবি কাইয়ুম নিজামী আলোচ্য তিনটি মহাকাব্যে দীর্ঘ এবং বিস্তৃত।

মহাকাব্য অক্ষয় কাব্য। এখানে কবির আত্মবাণী অপেক্ষা বিষয়বাণী ও বিষয় বিন্যাসই প্রধান।

আলোচ্য তিনটি মহাকাব্যে দেখা যায়, কবির আত্মবাণীর চেয়ে বিষয়বাণী ও বিষয় বিন্যাসকে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। মহাকাব্যের আখ্যান হবে পৌরাণিক যা ঐতিহাসিক। কাইয়ুম নিজামীর তিনটি মহাকাব্যেই ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ প্রতিফলিত হয়েছে।

মহাকাব্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যেখানে কোন অসাধারণ গুণসম্পন্ন পুরুষের কিংবা এক বংশোদ্ভব বহু নৃপতি বা রাজা-বাদশার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়, তাই মহাকাব্য। আলোচ্য মহাকাব্যের ঘটনাবলি উপরোক্ত সঙ্গার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যথার্থ বলেই প্রতীয়মান হয়। কাইয়ুম নিজামী বিশালায়তন গ্রন্থাকারে আমাদেরকে যে মহাকাব্য উপহার দিয়েছেন তাতে রয়েছে রসবোধ, হাসি-কান্নার চমৎকার এক অনুভ‚তির সাথে ঐতিহাসিক তথ্য।

কবির কল্পনা ও অনন্য মননশক্তির গুণে এই ত্রয়ী মহাকাব্য জাতির হৃদয়ে স্থান করে নেবে। উক্ত মহাকাব্যের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যার জীবনাচারসহ তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা যেভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাতে পুরো দেশ ও জাতির স্পন্দন অনুভ‚ত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, কালে কালে একটি সমগ্র জাতি যে কাব্যকে একজন কবির কবিত্বশক্তি আশ্রয় করিয়া রচনা করিয়া তুলিয়াছে তাহাকেই যথার্থ মহাকাব্য বলা যায়।

মহাকবি কাইয়ুম নিজামীর ত্রয়ী মহাকাব্য অবশ্যই মহাকাব্য হিসেবে একদিন স্বীকৃতি পাবে। আধুনিক কালে মহাকাব্যে তেমন একটা লেখা হয় না। মহাকবি মিল্টনের সমসাময়িক আরেক বিখ্যাত কবি ছিলেন ড্রাইডেন। তিনি চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত লিখতে পারেন নি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য সম্ভার আমাদের অত্যন্ত মূল্যবান সৃষ্টি। কিন্তু তারাও মহাকাব্য লিখেননি। অতি আধুনিক কালে অনেকেই মহাকাব্য লেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি।

আধুনিক কালে মহাকাব্য না লিখার কারণ হিসেবে পÐিতব্যক্তিরা
আধুনিক কালে মহাকাব্য লেখা হয় না। না লিখার কারণ কি? কারণ টি এই যে, লেখকের সময় নেই অতবড় লেখা লিখার, পাঠকেরও সময় নেই তা পড়ার? সেটা একটা কারণ যে তা অস্বীকার করা যাবে না। আরও একটা কারণ এই যে, আধুনিক কালে ব্যক্তির জন্য বীরত্বের কাল নয়। লোকে এখন ব্যক্তির অসামান্য বীরত্বে আর আস্থা রাখে না। তাছাড়া মানুষ এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পরস্পর থেকে। মহাকাব্যে দেখি নায়কেরা অনায়াসে মিশে যান অনেকের সঙ্গে, গ্রিক মহাকাব্যে অনেক মানুষ একসঙ্গে যুদ্ধ করে, জাহাজে চড়ে, দেশে ফেরে; নায়ক সেখানে অনায়াসে বন্ধুত্ব করেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে; কিন্তু একালে তো সেটা সম্ভব নয়।

কবি কাইয়ুম নিজামী কঠোর শ্রমের বিনিময়ে এমন একজন মহাবীরকে নিয়ে মহাকাব্য রচনা করেছেন, যিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, যিনি আমাদেরকে একটি জাতি, রাষ্ট্র, উপহার দিয়ে গেছেন। সেই সার্বজনীন মহাব্যক্তিত্ব হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত শেখ হাসিনাকে নিয়ে তিনি মহাকাব্য রচনা করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি আরেকটি মহাকাব্য রচনার জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। তার ভবিষ্যৎ মহাকাব্যের নায়ক মানব জাতির মুক্তির শেষ দূত, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স:)।

অনেকেই মনে করে থাকেন মহাকাব্য একটিই হবে এবং মহাকবি একজনই হবেন। আসলে তা সঠিক নয়। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত বহু মহাকবি বহু মহাকাব্য রচনা করেছেন। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের সর্বশেষ সংযোজন আলোচ্য তিনটি মহাকাব্য ‘টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম তোমার’ ‘কন্যার নাম শেখ হাসিনা’ এবং ‘হাজার কবিতায় বঙ্গবন্ধু’। আর এই তিনটি মহাকাব্যের মহাকবি হলেন একজন কাইয়ুম নিজামী। প্রশ্ন উঠতে পারে একজন ব্যক্তি কি একাধিক মহাকাব্য রচনা করতে পারেন। মহাকাব্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, বাংলা সাহিত্যে ত্রয়ী মহাকাব্যের কথা বলা হয়েছে। মহাকবি নবীন চন্দ্র সেনের রৈবতক, কুরুক্ষেত্র এবং প্রভাস- এই তিনটি মহাকাব্য একত্রে ত্রয়ী মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত। টলস্টয়ও লিখেছেন, ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ এবং ‘আন্না কারেনিনা’ নামের দু’টি মহাকাব্য। মহাকবি হোমার লিখেছেন দু’টি মহাকাব্য ‘ইলিয়ড’ ও ‘অডিসি’। মহাকবি কাইয়ুম নিজামী এ কালে তিনটি মহাকাব্য রচনা করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন।

বাংলাদেশের কাব্য জগতের ইতিহাসে এই প্রথম একই ব্যক্তি কর্তৃক লিখিত এই তিনটি মহাকাব্য এক অনন্য ও অভিনব সংযোজন। যে ইতিহাসের ¯্রষ্টা হলেন কবি কাইয়ুম নিজামী। যিনি মহাকাব্য রচনা করেন, তিনি মহাকবি নামে পরিচিতি পেয়ে থাকেন। সে কারণেই কাইয়ুম নিজামী কবি থেকে মহা কবি।

অধ্যাপক এম. আর. মাহবুব
লেখক, গবেষক, এবং নির্বাহী পরিচালক
ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ঢাকা।

আপনার মন্তব্য লিখুন...

ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মসজিদ কর্তৃপক্ষকে মারধরের হু সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে আহত এসআই : গ্রেফতার ১৬ মির্জাপুরে গরীব ও দুস্থ মহিলাদের মাঝে সেলাই মেশিন বিতরণ মির্জাপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় নারীসহ এক পরিবারের ৪জন আহ মির্জাপুরের বাঁশতৈলে ৮টি অবৈধ কয়লার চুল্লি ধ্বংস ধনবাড়ীতে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত চলন্ত ট্রেনের ছা‌দ থে‌কে যাত্রীর মর‌দেহ উদ্ধার নাগরপুরে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার দিলেন তারানা হালিম বঙ্গবন্ধু সেতুতে একদিনে ৩কোটি টাকার টোল আদায় ''মানুষের কল্যাণে মানুষ'' ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ঈদ সামগ্র ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে ১৭ কিলোমিটার এলাকা ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড সাইন্স এন্ড টেকনোলজি বা ফুড টেকনো ঈদের বাজার নিয়ে এবার বাড়ি ফিরবে না মেহেদী ৩২ ঘন্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু পাড় হয়েছে প্রায় ৪২ হাজার পরিবহ পীর শাহজামান মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির উদ্যোগে ইফতার মাহফ

© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি

নির্মান ও ডিজাইন : মঈনুল ইসলাম, পাওয়ার বাই: জিরোওয়ানবিডি